“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়, হে কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়?”- আসলে প্রতিটা মানুষই স্বাধীনতা চায়, মুক্তভাবে বাঁচতে চায়। স্বাধীনতা এই চার অক্ষরের শব্দটি অনেক অর্থবহ। কেউই চায় না উপেক্ষা, অন্যায় অত্যাচার, আর শোষিত হতে। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই মুক্তিকামী। এজন্যই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দলনে যে মুক্তির বীজ বপণ করা হয়েছি তা কালক্রমে এসে ডালপালা ছড়ায় ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ এক ভয়ংকর, রক্তক্ষয়ী মাস। আবার অন্যদিকে গৌরবেরও। ১৯৭১ সালেই আমরা অর্জন করেছিলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ২৬ শে মার্চের স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘশনার পরেই বীর বাঙালি ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। তবে স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে বিশদভাবে আমরা অনেকেই জানি না । আসুন এখন জেনে নিই, ২৬ শে মার্চের ইতিহাস, বাংলাদেশ শব্দটির উদ্ভাবন এইসব বিষয় নিয়ে।
“বাংলাদেশ” আমাদের হলো যেভাবেঃ
১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর দেশটির প্রথম সংবিধান প্রণয়ন ও গৃহীত হয়। সেখানে স্বাধীন এই দেশটির সাংবিধানিক নাম রাখা হয় ‘বাংলাদেশ’।
রাজনৈতিকভাবে এই ভূখণ্ডের নামকরণ ‘বাংলাদেশ’ করার দাবি উঠতে শুরু করে ১৯৬৫ সাল থেকে। এরপর ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের স্লোগানে ‘বাংলাদেশ’ নামটি আসে। একই বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব রাখেন। পরে সত্তরের নির্বাচন ঘিরে এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতা দাবি করার পাশাপাশি এর নাম ‘বাংলাদেশ’ করার দাবি তীব্র হয়।
উনিশ শতকের সাহিত্যে অবিভক্ত বাংলাকে ‘বঙ্গদেশ’ বা ‘বাংলাদেশ’ বলা হতো।
২৬ শে মার্চ এর ইতিহাসঃ
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম! জয় বাংলা!”
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। বাঙালির ইতিহাসে এক ভয়াল সময়কাল। ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায়। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে আটক হোন। তিনি আটক হবার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। সেই ঘোষণা তিনি দেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা থেকেই।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই ভাষণ সম্প্রচার করা হয়। তৎকালীন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বেতারের চট্টগ্রামের কয়েকজন কর্মী শহর থেকে অনেকটা দূরে নিরাপদ জায়গা হিসাবে কালুরঘাটে বেতারেরই ছোট্ট একটি কেন্দ্রে তাদের প্রথম অনুষ্ঠান করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান।
২৬ শে মার্চকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা হয় কখন ও কত সালে?
অনেক বাঙালিই জানে না, ২৬ শে মার্চকে কবে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয় । স্বাধীনতা বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালে। এরপরে উদ্যোগ নেওয়া হয় স্বাধীনতা দিবস কার্যকর করার জন্য। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি একটি বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করে ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা হয়।
২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস কেন পালন করা হয়?
৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমদের স্বাধীনতা অর্জিত। স্বাধীনতা দিবস কেন পালন করা হয়, সেটির উৎস অনুসন্ধান করতে হলে আগে জানতে হবে কেন আমরা এতো রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা আনলাম?
- স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক, কল্যাণমুখী, মানবিক, প্রগতিশীল স্বতন্ত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
- মানুষের মৌলিক অধিকার ও ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত হবে এমন একটি দেশ প্রতিষ্ঠা ।
- জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা, শোষণ, বৈষম্য, অন্যায়ের অবসান ঘটান।
- ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ।
- সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা।
জাতীয় জীবনে ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্যঃ
“স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন”।
তাই স্বাধীনতা অর্জন করার পর সেই আদর্শের বাস্তবায়ন যেন বজায় থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে আমাদের স্বাধীনতার। কিন্তু কতটুকু এগিয়ে গেল বাংলাদেশ? জাতি হিসেবে আমরাই বা কী পেলাম? ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্বের দুর্বিপাকে এখনও আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। পাশাপাশি আছে দুনীর্তির মহোৎসব! মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানবিকতার অবনমন, হিংসাত্মক অপরাজনীতি, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি আমাদের টেনে ধরে রেখেছে পিছনের দিকে।
কিন্তু এর মাঝেও আছে খুশির খবর। স্বাধীনতা উত্তরকালে যে দেশকে একদিন কিসিঞ্জার বলেছিল তলাভাঙ্গা ঝুড়ি, আজ সে দেশই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। দেশের অর্থনীতি ক্রমশ উন্নতির দিকে। , এবং শুরুর দিকের দৈন্যদশা কেটেছে অনেকাংশেই। আমরা যদি সবাই দেশকে ভালোবেসে দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার শপথ নিই, ঠিকঠাক কাজ করি তবেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ হবে। পরবর্তী প্রজন্ম পাবে সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা!
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণার খবরঃ
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও শেখ মুজিবকে আটকের ঘটনা ২৭শে মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশিত হয়।
- বিবিসির খবরে তখন বলা হয়, “…কলকাতা থেকে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ যে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।…”
- ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়: “ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। তিনি সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।”
- ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২৭শে মার্চের এক খবরে বলা হয়, “২৬শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার পরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।”